লাঠিখেলাঃ লাঠি খেলা এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনা শিল্প। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তাদের নৈমিত্তিক জীবনের উৎসব-বাংলা বর্ষ বরণ, বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে লাঠি খেলার আয়োজন করে থাকেন। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো লাঠিয়াল দলকে ভাড়া করে আনা হয়। আর লাঠিয়াল দল তাদের দৈনন্দিন জীবনের পোশাকে বায়না পাওয়া গ্রামে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি করে ডাক ভাঙতে থাকেন। তাদের সে ডাক ভাঙার শব্দ শুনে গ্রামের লোকজন তো বটেই আশে পাশের গ্রামগুলোতেও লাঠি খেলার সংবাদ রাষ্ট্র হয়ে যায়।
এক সময় এই বীরগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা মেতে ঊঠত লাঠি খেলার তুমুল আনন্দে। কালের প্রবাহে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী লাঠখেলা।সেই লাঠিয়াল ও নেই লাঠিখেলাও নেই।
গরুর গাড়ীঃ
ফুলকপি, শিম, মটর আর সরষে ক্ষেত পার হয়ে চলেছে গরুর গাড়ির শোভাযাত্রা। কুয়াশা ভেদ করে কানে ভেসে এল এক সম্ভাষণ: বাহে...কোন্ঠে যাছেন? বিয়াবাড়ি নাকি বাহে? ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে। মিনারের মাথার মতো, পাঁজা করা খড়ের স্তূপের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসা এক সরল বৃদ্ধের মুখে ফুটে উঠল সকালের নরম হাসি। কেউ তাঁর প্রশ্নের তেমন কোনো জবাবও দিল না, গাড়োয়ানরা শুধু হাসল। চোখের সামনে ভসে আসে গ্রামের কোন আকা বাকা মেঠো পথ, যে পথ দিয়ে হেলেদুলে চলছে গরুর গাড়ি। এক সময় আমাদের গ্রামগুলি ছিল এমনই অযান্ত্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ। সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে সমাজের চিত্র। সভ্যতার ক্রমবিকাশে আমাদের যান্ত্রিক জীবন চলে গেছে বহু দুরে। তার পরও গ্রামের পথে চলে গরুর গাড়ি।
একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে কুটুম আসত পালকি কিংবা গরুর গাড়ি চড়ে; বিয়ের বর যাত্রী এসেছে গরুর গাড়ীতে চড়ে। নাইওরী যাবে বাপের বাড়ি, তাই প্রয়োজন গরুর গাড়ী। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, রেলস্টেশন থেকে বাড়িতে যাওয়া-আসার জন্য একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি। সে যাওয়া-আসারও একটা বিশেষ ধরন ছিল। গরুর গাড়ির চালির উপরে নৌকার ছইয়ের মতো ছাউনি দেওয়া হতো। ছাউনির ভেতরে যাত্রীরা বসে থাকত। ছাউনির দু'পাশে শাড়ি কাপড় টাঙিয়ে পর্দার ব্যবস্থা করা হতো। সাথে থাকত টিনের ট্রাংক, কিংবা কাপড় পেচানো পোটলা-পাটলি। শীতের সময় হলুদ সরষে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে গাড়িয়ালরা চলতেন পল্লীবালাদের নিয়ে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়িয়াল সুর করে এক রকম লোকগীতি গাইত। গরুর গাড়ির চাকার ক্যাচর ক্যাচর শব্দ আর সেসব গান পল্লীর পথে এক ভিন্ন আমেজ ছড়িয়ে দিত। এখনও পল্লীবাংলায় মাঠ আছে, সেসব মাঠে সরষে ফুলও ফোটে। কিন্তু গরুর গাড়ির ওই দৃশ্য সহজে চোখে পড়ে না। আধুনিক যানবাহন আসায় এখন সাধারণত কেউ আর গরুর গাড়িতে চড়তে চায় না। নাইওরীর বাপের বাড়ী যাওয়ার কিংবা গরুর গাড়ীতে বরযাত্রী আসা এখন কেবল স্মৃতির পাতায় ঝুলে থাকা অধ্যায়।
গরুর গাড়ি আমাদের পল্লীবাংলার এক ধরনের লোকশিল্প, কুটির শিল্পও বটে। গাড়ি চাকা তৈরি করে এক বিশেষ শ্রেণীর কারিগর। সেই চাকা কিনে নিয়ে গায়ের মিস্ত্রি কিংবা নিজেরাই গরুর গাড়ি তৈরি করেন। গরুর গাড়ি মূলত বাঁশের তৈরি হলেও কোনো কোনো অংশ যেমন চাকা তৈরি হয় মুলতঃ বাবলা কাঠ দিয়ে। বিশাল এক জোড়া বড় চাকাই হলো এর অন্যতম প্রধান অংশ। চাকা দুটি একটা দণ্ড দিয়ে যুক্ত করা হয় - একে বলে ধুরে। চালির মতো বাঁশের তৈরি অংশকে বলে বাত্তি বা চালি। বাত্তির নিচে দু'পাশে লম্বা, মোটা ও শক্ত বাঁশ বা কাঠের দণ্ডকে বলা হয় সেতেরা। বাত্তির পেছন দিক চওড়া, সামনের দিক চাপা। পুরো বাত্তির দু'পাশে থাকে মজবুত দুটি বাঁশের দণ্ড, একে ফর বলে। সামনে এ দুটি দণ্ড একটি চণ্ডি কাঠ দিয়ে যুক্ত থাকে, যাকে অঞ্চলভেদে জোঙালও বলে। চণ্ডি কাঠের সামনে থাকে বিষখিলি, জোয়াল ও কানখিল বা ছিলমে। জোয়াল বা জোঙাল গরুর কাঁধে তুলে দেওয়া হয়। দু'পাশে দুটি গরু জোয়াল কাঁধে গাড়ি টেনে চলে। যাত্রীবহনের গাড়িতে নৌকার মতো ছই থাকে। ছইয়ের ভেতরে বাত্তির ওপর পাটি বা বিছানা পেতে যাত্রীরা বসে থাকে। কোনো কোনো সময় গরুর গাড়িতে ধানের আঁটি বোঝাই করার পর সেগুলো যাতে চলার সময় পড়ে না যায়, সে জন্য লম্বালম্বিভাবে এটি বাঁশ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এই বাঁশকে বলে আঁটার বাঁশ।
সভ্যতার এই পর্বে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই গরুর গাড়ি কমে গেছে। গ্রামে গ্রামে পাকা সড়কে এখন দ্রুত চলে ভটভট করে নছিমন-করিমন-আলম-সাধু। মুহুর্তেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পণ্য পরিবহন করা যায়, খরচও কম পড়ে। তাছাড়া গরুর গাড়ির ভালো কারিগরও এখন সহজে মেলে না। এখন একটা গরুর গাড়ি বানাতে ১০ হাজার টাকারও বেশি লাগে, দুটি চাকার দামই প্রায় পাঁচ হাজার টাকা পড়ে, দুটি বলদের দাম আশি থেকে নব্বই হাজার টাকা। তারপর আছে গরুকে খাওয়ানোর খরচ, আছে বলদ পালনের ঝামেলা। সব মিলিয়ে এই 'সস্তা' ভাবা গরুর গাড়ির পেছনে বিনিয়োগ প্রায় লাখ টাকা। অথচ ত্রিশ-চলি্লশ হাজার টাকায় একটা নছিমন-করিমন পাওয়া যায়।এখন গরুর গাড়ি পোষার দিন নাই। সেই দিন আর বেশি দুরে নাই যেদিন পল্লীর গরুর গাড়িকে দেখতে হলে জাদুঘরে যেতে হবে।
পালকিঃ কালের বিবর্তনে কতো কিছু পাল্টায়—পাল্টায় সংস্কৃতি, সভ্যতা সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মানুষের জীবনধারা। এ পরিবর্তনের রেশ ধরেই হারিয়ে যায় সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক পুরনো ঐতিহ্য। এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে পালকি অন্যতম।
এক কালে এদেশের জমিদার-নবাবসহ সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা কোথাও যাতায়াত করলে পালকি ছাড়া চলতোই না যেন। তাদের সামান্য পথটুকু চলতেও পালকি লাগতো। যেমন—তাদের খাসমহল থেকে ঘোড়ার পিঠ পর্যন্ত বা পানসি ঘাট পর্যন্ত যেতেও পালকি ব্যবহার করা হতো। এ তো গেলো এক শ্রেণীর লোকদের কথা। এরা ছাড়াও সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের বরণ করতে তত্কালে পালকির বিকল্প যেন পালকিই ছিলো। সে আমলে বিদেশি কোনো মেহমান এলেও তাকে পালকিতে চড়িয়ে বরণ করা হতো। যেমনটা করা হয় বর্তমান দিনে অতিথিদের সম্মানে মোটর শোভাযাত্রায়। সে যা হোক, পালকির কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার এদেশে আসা ভ্রমণ কাহিনীতে। তার লেখার মধ্যে এ কথাও পাওয়া যায় যে, তিনি পালকি বহনের দৃশ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তখনকার দিনের বিয়ে এবং পালকি এ যেন ছিলো একই সুতোয় গাঁথা। আমাদের দেশে এমন এক সময় গেছে যখন বিয়ের অনুষ্ঠান পালকি ছাড়া হতোই না, পালকি ছাড়া বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে যেন নিজেদের হতভাগা বলে মনে করা হতো। নতুন বউ তুলে দেয়া হতো বরের বাড়িতে পালকিতে করে। আবার এ বিয়ে উপলক্ষে পালকি সাজানো হতো মনোলোভা ও দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে। সব পরিবারে আবার পালকি ছিলো না। তখনকার দিনে বিত্তশালী ও উচ্চবংশীয় লোকদের প্রত্যেকের বাড়িতে পালকি ছিল বংশের মর্যাদার প্রতীক। সাধারণ পরিবারের লোকদের বাড়িতে পালকি ছিল না বললেই চলে। তাই বলে তাদের উত্সব পার্বণ পালকি ছাড়া হতো তা কিন্তু নয়। তাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা ছিলো। সে সময়ে কিছু কিছু মানুষ এ পালকি নিয়ে বাণিজ্য করতো, মানে পালকি বানিয়ে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিতে দিতো। এ জন্য পালকি মালিকদের দিতে হতো মোটা অংকের কড়ি বা
টাকা অথবা তার সমতুল্য অন্য কোনো জিনিস।
পালকিকে ঘিরে আরো কিছু লোক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো। এ লোকদের বলা হতো ‘কাহার’বা ‘বেহারা’। যেদিন তাদের দরকার হতো তার আগে ‘বায়না’স্বরূপ মাইনে দিতে হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন বিয়ে বাড়িতে তাদের খাওয়ানো হতো জামাই আদরে। এছাড়া তাদের সম্মানী দিতে হতো বরপক্ষ থেকে।
মেয়ে বাবার বাড়িতে নাইওর যেতেও ব্যবহার করতো পালকি। পালকিতে চারজন বেহারা বা কাহার প্রয়োজন হতো। গ্রামগঞ্জে অন্যান্য লোকালয়ে পালকিতে করে বউ নেয়া, দৃশ্য চোখে পড়তো। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে নতুন বউটি বাইরে দৃষ্টি দিতো কান্না ভেজা চোখে। যখন বেহারারা বউ নিয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রাম পেছনে ফেলে, তখন তাদের কণ্ঠে চলতো পালকি বহনের গান—‘হুন হুনা হুন হুনরে’বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে।’আরো এরকম হৃদয় ছোঁয়া গানে গ্রামগঞ্জ যেন জেগে উঠতো নতুন প্রাণে। তাদের পালকি বহনের সময় পা ফেলার আলাদা তাল বা ছন্দ ছিলো। সেই ছন্দ আর তালের সঙ্গে নিজস্ব গানে গানে কাঁধে নিয়ে বইতো পালকি।
এখন আর আমাদের গ্রামগঞ্জ, শহর, বন্দরে দেখা যায় না পালকি বহনের দৃশ্য। পালকি এখন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য। পালকির সেই ঐতিহ্যময় ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি নানান রংয়ের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন স্বপ্ন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গান।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS